জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরই অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ। আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া এ শ্রম অসন্তোষের কারণে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন রপ্তানিকারকরা। তবে সব শঙ্কা উড়িয়ে টানা চার মাস দেশের রপ্তানি আয় চার বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে। শুধু জানুয়ারিতেই রপ্তানি আয় ৪৪৪ কোটি ডলার।
জানুয়ারি মাসের রপ্তানি আয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২৮দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় এসেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ রপ্তানি আয় ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় ছিল ২৫ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।
সাত মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে মূলত পোশাক খাতের ওপর ভর করে। এ সময় তৈরিপোশাকে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১২ শতাংশ, কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘদিন নেতিবাচক ধারায় থাকলেও এ বছর এসব পণ্যের রপ্তানি আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এটি এখন দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য। তাছাড়া রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে রাবার পণ্যের ৩৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ, সাইকেল রপ্তানি প্রায় ৬৪ শতাংশ, জাহাজ রপ্তানি ৩ হাজার ১৬৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গত কয়েক মাসে বেশ শঙ্কার মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা, পোশাক শ্রমিকদের অস্থিরতার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ফলে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। শিল্প খাতে জ্বালানি ও কাঁচামালের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানি নির্ভরতা ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে শিল্পখাত ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। এ প্রেক্ষিতে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনছে। প্রবাসী আয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখছে। তবে রপ্তানির এ তথ্যের মাধ্যমে শিল্পখাতের নেতিবাচক দিকগুলো উঠে আসেনি।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, যদিও প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান উৎসাহব্যঞ্জক, তবুও শিল্পের মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে দাম এবং পণ্য উৎপাদন খরচের ওপর চাপকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করে না। এই প্রবণতাকে প্রভাবিতকারী নির্দিষ্ট কারণগুলি চিহ্নিত করার জন্য আরও বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যেমন বাজার-নির্দিষ্ট কর্মক্ষমতা, পণ্য এবং বাজার কেন্দ্রীকরণ এবং অন্যান্য পরিবর্তনশীল।
তিনি বলেন, গত বছর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যার ফলে তীব্র মূল্য প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছে। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাধ্যমে আসন্ন বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য কিছু সুযোগ রয়েছে। তবে, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং আর্থিক-ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতাসহ ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে বেশ কয়েকটি অগ্রাধিকার বিবেচনা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। টানা চার মাস ধরে ৪ বিলিয়ন মানে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে ৪৪৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি।
পরিসংখ্যান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল সোমবার পণ্য রপ্তানি আয়ের এই হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস জুলাই-জানুয়ারিতে দেশ থেকে মোট ২ হাজার ৮৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি এর আগের ২০২৩–২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত জানুয়ারি মাসে তৈরি পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা, হিমায়িত খাদ্য ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। তবে চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও প্লাস্টিক পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি কমেছে। কিন্তু রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি যেহেতু তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে, সেহেতু এই খাতের রপ্তানির ওপরই নির্ভর করে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি। এই খাতে জানুয়ারি মাসের রপ্তানিতে ৫ দশমিক ৫৭ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিও এর কাছাকাছিই রয়েছে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, অভ্যুত্থানের কারণে গত জুলাই ও আগস্টে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমেছিল। সেপ্টেম্বরে অবশ্য ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়; রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৮৬ কোটি ডলার। অক্টোবর ও নভেম্বরে যথাক্রমে ৪১৩ ও ৪১১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। তার মধ্যে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অক্টোবরে ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও নভেম্বরে সাড়ে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। আর ডিসেম্বরে ৪১১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৮ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২ হাজার ৩৫৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। শুধু জানুয়ারিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৬৬ কোটি ডলারের। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
শাশা ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ আমার দেশকে বলেন যে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে রপ্তানি আয় স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে, যা একটি ইতিবাচক প্রবণতা প্রতিফলিত করে।
স্থানীয় পিছিয়ে পড়া শিল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি সরকারের প্রতি মূল্য সংযোজন মার্জিন বিশ্লেষণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ফলস্বরূপ, পোশাক রপ্তানিকারকরা ক্রমবর্ধমানভাবে আমদানি করা সুতা এবং কাপড়ের উপর নির্ভরশীল হচ্ছেন।
মাহমুদ স্থিতিশীল জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার এবং পরিবেশবান্ধব রূপান্তরকে এগিয়ে নিতে নীতিমালার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন।
মার্কিন সরকারের ১০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চীন থেকে অর্ডারের পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা এই ডাইভার্টেড ক্রয়াদেশের প্রায় ১৫ শতাংশ দখল করতে পারব।’
উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, বাজারের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে শক্তিশালী অর্ডার পাচ্ছেন। তিনি বলেন, রপ্তানিকারক হিসেবে, আমরা [উর্মি গ্রুপ] গত বছরে ১১ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।
বিকেএমইএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সাম্প্রতিক সময়ে অর্ডার বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করলেও ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয় রপ্তানিকারকদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘মূল্য প্রতিযোগিতামূলকতা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে, এবং ক্রেতাদের লিড টাইম পূরণের জন্য পর্যাপ্ত ইউটিলিটি সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি, যা ক্রেতাদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য।
রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও কিছু পণ্য ও খাতের ক্ষেত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কৃষিপণ্য ও সামুদ্রিক খাবারের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি উচ্চ চাহিদার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রাথমিক পণ্য রপ্তানিতে ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশেষত কিছু পণ্য উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন সাত মাসে কাঁকড়া রপ্তানি বেড়েছে ৪০ দশমিক ১৯ শতাংশ, আর এ পণ্যটি শুধু জানুয়ারি মাসেই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০৮ শতাংশ। তামাক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ৫৬ শতাংশের বেশি ও শুধু জানুয়ারিতেই বেড়েছে ৬৭৮ শতাংশ। বাংলাদেশের ফলমূল রপ্তানিও আশা জাগিয়েছে। সাত মাসে ফল রপ্তানি বেড়েছে ২০৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। শুধু জানুয়ারি মাসেই ফল রপ্তানি বেড়েছে ৪৭২ দশমিক ২২ শতাংশ।
পাট ও পাটজাত পণ্যের হ্রাস রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। কাঁচ পণ্য ও অন্যান্য শিল্প-ভিত্তিক পণ্যের নিম্নগামী প্রবণতা উদ্বেগজনক হার দেখা গেছে জানুয়ারি মাসে। কিছু পণ্যের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে চলতি অর্থবছর। যেমন: শাক-সবজি রপ্তানি কমেছে ৫১ শতাংশ, শুকনো খাবার রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ, চিনি ও চিনি জাতীয় পণ্য রপ্তানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি।