পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ড। এ সত্যটি বারবার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এই অঞ্চলে বারবার উত্তেজনা, সংঘাত ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে নানা শক্তির অদৃশ্য হাত কাজ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে নতুন করে স্পষ্ট হয়েছে ভারতের গোপন তৎপরতা। জানা গেছে, ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) ও জেএসএস (জনসংহতি সমিতি)-এর শীর্ষ ৯ নেতা ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম ও কলকাতা অঞ্চলে প্রায় ২৫ কানি জমি ক্রয় করেছেন। জমি কেনার অর্থনৈতিক উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সংগৃহীত চাঁদাবাজি, অপহরণ ও চোরাচালানের অর্থ।
ভারতের নরম কৌশল; জমি, আশ্রয় ও ম্যানেজমেন্ট:
গোপন সূত্রে জানা যায়, ভারত এসব নেতাদের জন্য সহজ শর্তে জমি কেনা, নাগরিক সুবিধা গ্রহণ এবং স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করেছে। তারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে নিরাপদ আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষাসুবিধা এবং যোগাযোগের সুবিধা পাচ্ছে। ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে ইতোমধ্যে ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর কিছু প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে আধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ, কৌশলগত পরিকল্পনা ও প্রোপাগান্ডা তৈরির কাজ চলে। এমন এক পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত আসলে ‘মানবিক সহায়তা’র মুখোশে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে। ভারতের এই নরম কৌশল কেবল সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়া নয়, বরং তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ।
জুম্মল্যান্ড; ভারতের স্বপ্ন, পাহাড়ের দুঃস্বপ্ন:
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ‘জুম্মল্যান্ড’ নামে একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ গঠন, যা ভবিষ্যতে ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অঞ্চল হিসেবে দাঁড়াবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে এই তথাকথিত প্রদেশের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সম্পর্ক দেখিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে দাবি তোলার চেষ্টা হতে পারে।
এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা, কয়েকটি এনজিও এবং মানবাধিকার তকমাধারী কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা একযোগে কাজ করছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিকে ‘অধিকারের হুমকি’ হিসেবে প্রচার করছে এবং উপজাতি জনগণকে বিভ্রান্ত করছে যেন তারা রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারায়।
ইউপিডিএফ ও জেএসএস; ‘অধিকার আন্দোলন’ না, অর্থের রাজনীতি:
ইউপিডিএফ ও জেএসএস নিজেদের পরিচয় দেয় ‘উপজাতি অধিকার আন্দোলনের সংগঠন’ হিসেবে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরা মূলত চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ এবং ত্রিপুরা-মিজোরাম সীমান্তে পাচারকার্য থেকে অর্জিত টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। এখন জানা যাচ্ছে, সেই অর্থের বড় অংশ ভারতে জমি ও সম্পদ কেনায় ব্যবহার করা হচ্ছে। অধিকার আদায়ের নামে এরা সাধারণ পাহাড়ি জনগণকে ব্যবহার করছে, ভয়ের রাজনীতি সৃষ্টি করছে। যারা রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্পে অংশ নিতে চায়, তাদের উপর সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। গ্রাম্য পর্যায়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে সেনাবাহিনী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উত্তেজনা তৈরি করা তাদের প্রধান কৌশল।
পাহাড়ে বিদ্বেষ সৃষ্টিতে ভারতের ভূমিকা:
ভারত তার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে ‘ম্যানেজ’ করে রাখছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা নিয়মিত দিকনির্দেশনা পায়। ভারত তাদের মাধ্যমে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সংঘর্ষে উসকানি দিচ্ছে। এভাবে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি জিইয়ে রেখে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দুর্বল করতে চায়। এটি একদিকে বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টেরও চেষ্টা চলছে।
চাঁদাবাজি থেকে জমিদারী; পাহাড়ের নেতাদের বিলাসিতা:
ইউপিডিএফ ও জেএসএস নেতাদের অনেকে এখন ভারতে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। চাঁদাবাজির টাকায় তারা জমি, ব্যবসা ও বাড়িঘর কিনে ফেলেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন কলকাতায় উচ্চশিক্ষার নামে সন্তানদের পাঠিয়ে স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করছে। বাংলাদেশে এরা দাবি তোলে ‘পাহাড়ি অধিকার’, কিন্তু বাস্তবে তাদের দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ ভারতীয় জমি, ত্রিপুরার ব্যাংক একাউন্ট এবং বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের অর্থে। তাদের লক্ষ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন নয়, বরং একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নকে জিইয়ে রাখা।
রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ; প্রতিরোধই একমাত্র পথ:
বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বহুবার এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। এসব প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট যে, ভারতের মদদে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। রাষ্ট্রের উচিত এ বিষয়ে এখনই শক্ত অবস্থান নেওয়া। যেমন-
১. ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর অর্থনৈতিক উৎস চিহ্নিত করে বন্ধ করা।
২. সীমান্তে গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারি বাড়ানো।
৩. পাহাড়ে উন্নয়ন, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে সাধারণ উপজাতিদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা।
৪. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের এই নাশক পরিকল্পনার বিরোধিতা করা।
পরিশেষে বলা যায়: পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এখানে ‘জুম্মল্যান্ড’ নামের কোনো কল্পরাজ্য গড়ার স্বপ্ন কখনোই সফল হবে না। যারা ভারতের ইশারায় দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা ছড়াতে চায়, তারা কেবল দেশদ্রোহী নয়, বরং নিজেদের জাতিগোষ্ঠীর শত্রু। আজ পাহাড়ের প্রকৃত মুক্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে, বিভ্রান্তির রাজনীতি নয় বরং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য, ঐক্য ও শান্তির পথেই ফিরতে হবে। পাহাড়ে শান্তি মানেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার আরেকটি বিজয়, আর ভারতীয় ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা মানেই সার্বভৌম বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষা।
_লেখক:- এম মহাসিন মিয়া, সাংবাদিক ও লেখক খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।

