যেকোনো দেশে অভাবনীয় রাজনীতিবিদ থাকে। তবে ক’জনই বা দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হয়! দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি, দেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির প্রতি রাজনীতিবিদের দায়বদ্ধতা থাকেনা বলে রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস জন্মায়।
রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস জন্মানোর কয়েকটি কারণ:
১. ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। অনেকে দেশের স্বার্থের আগে নিজের ক্ষমতা, অর্থ বা পরিবারকে এগিয়ে রাখেন। ২. দলীয় স্বার্থকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখা। যেকারণে জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যের বদলে দলীয় দ্বন্দ্ব দেখা যায়। ৩. দুর্নীতি ও লুটপাট, সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যবহার করা হয়। ৪. জনগণের সঙ্গে দূরত্ব, ভোটের সময় প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে সেসব রক্ষা করা হয় না। ৫. ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার প্রবণতা, দেশ গঠনের চেয়ে কিভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যায়, সেটিই মুখ্য হয়ে যায় (বিগত সরকারের আমলে প্রমাণিত)।
কেন বলা হয় রাজনীতিবিদরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক নয়: দেশপ্রেমিক মানে হলো দেশের জন্য আত্মত্যাগ, স্বচ্ছতা, সততা, ন্যায়বিচার রক্ষা করা। কিন্তু রাজনীতির মাঠে প্রায়শই দেখা যায় ক্ষমতার জন্য বিদেশি প্রভাব খোঁজা, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার, বা জনগণের কণ্ঠ রোধ করা। এতে স্পষ্ট হয় যে, অনেকে ‘দেশ’ নয় বরং নিজ স্বার্থ বা দলকে অগ্রাধিকার দেন।
তবে সবাই একরকম নয়: ইতিহাসে যেমন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সেরে বাংলা একে ফজলুল হক, জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক বলা হয়। তেমনি বর্তমানেও কিছু সৎ, দেশপ্রেমী ও ত্যাগী নেতা রয়েছেন। সমস্যা হলো, তাদের সংখ্যা তুলনামূলক কম, আর দুর্নীতিগ্রস্ত বা ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদরা বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।
মূল সমস্যা: রাজনীতি পেশা হয়ে গেছে, আদর্শ নয়। জনগণকে সেবা নয়, ক্ষমতা ভোগের মাধ্যম মনে করা হয়। দেশপ্রেমের বদলে ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা চলছে। সবশেষ হলো যে, সবাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক নন, তবে একেবারেই নেই তাও বলা যায় না। সমস্যা হলো, রাজনীতিতে দেশপ্রেমিকদের প্রভাব অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে, আর স্বার্থান্বেষীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট; রাজনীতিবিদরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক নয়:
_ক্ষমতার লোভ দেশপ্রেমকে আড়াল করে: স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনের পরিবর্তে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি শুরু হয়। একের পর এক সামরিক শাসন, দল ভাঙা, ক্ষমতার জন্য হত্যা-ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এতে দেশের উন্নয়নের চেয়ে ক্ষমতার রাজনীতি প্রাধান্য পায়। ক্ষমতার পালাবদলে দেশ দারুণ অস্থিতিশীল হয়। প্রকৃত দেশপ্রেমের বদলে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরাই মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
দুর্নীতি ও লুটপাট: নির্বাচনের সময় সবাই ‘দেশ গড়ার’ অঙ্গীকার করে, কিন্তু ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি বেড়ে যায়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, হলমার্ক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি সহ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। প্রবাসীরা কষ্ট করে রেমিট্যান্স পাঠালেও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ সেই অর্থ বিদেশে সম্পদ বানাতে ব্যবহার করেছে। প্রকৃত দেশপ্রেম থাকলে দেশের সম্পদ দেশেই বিনিয়োগ করা হতো, বিদেশে পাচার করা নয়।
দলীয় স্বার্থকে রাষ্ট্রের উপরে রাখা: উদাহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল৷ জাতীয় স্বার্থে ঐক্য গড়ার পরিবর্তে সবসময় একে অপরকে হেয় করার রাজনীতিতে লিপ্ত।
যেমন- পদ্মা সেতু প্রকল্পকে ঘিরে একপক্ষ বলেছে দুর্নীতি হয়েছে, অন্যপক্ষ বলেছে ষড়যন্ত্র। ফলে আন্তর্জাতিক মহলেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে দেশপ্রেম নয়, দলীয় রাজনীতিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাছাড়া ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে দুঃশাসনের শিকল ছিড়ে আওয়ামী লীগ সরকারের তো পতনই হলো।
বিদেশি প্রভাব খোঁজা: বাংলাদেশের রাজনীতির বড় দলগুলো প্রভাব খাটাতে অনেক সময় ভারত, চীন, আমেরিকা বা অন্য শক্তিধর দেশের সহায়তা চায়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, নির্বাচনের সময় বিভিন্ন দলকে দেখা যায় বিদেশি কূটনীতিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হলে বিদেশিদের কাছে নয়, জনগণের কাছে জবাবদিহি করাই যথেষ্ট হতো।
জনগণের জীবন নিয়ে উদাসীনতা: দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, বিদ্যুৎ, কর্মসংস্থান সহ প্রায় সবখানে দুরবস্থা। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, করোনাকালে অক্সিজেন ও আইসিইউর সংকটে অনেক মানুষ মারা যায়। বর্তমানে দেশের বহু হাসপাতালে ভালো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই, সেবার মানও সুনিশ্চিত নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নেওয়া হয় না। যদি সত্যিই দেশপ্রেম থাকত, তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো।
ব্যতিক্রমও আছে: উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় চার নেতা সহ আরও অনেকেই। তারা দেশের জন্য, দেশের মাটি ও মানুষের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অধিকার আদায়ে লড়াই, আন্দোলন, সংগ্রাম ও কাজ করে গেছেন। ফলে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। তারাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন, কিন্তু আজকের রাজনীতিতে তাদের মতো নেতা ও দেশপ্রেমিকের সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশে অনেক রাজনীতিবিদ দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, তবে বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনীতি হয়ে গেছে ক্ষমতা, অর্থ আর দলীয় স্বার্থের খেলা। এজন্যই মানুষ প্রায়ই বলে থাকেন ‘রাজনীতিবিদরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক নয়’।
_এম মহাসিন মিয়া, সাংবাদিক ও লেখক। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।

